ঐক্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচন– শাসকশ্রেণি গলদঘর্ম

ঐক্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচন– শাসকশ্রেণি গলদঘর্ম
আন্দোলন প্রতিবেদন
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | অনলাইন সংস্করণ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিন যতই পার হচ্ছে, ততই শাসকশ্রেণির বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দল, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বেড়ে চলেছে। আর তাকে জনগণের কাছে গোপন করার জন্য তারা ঐক্যের গলাবাজী দিয়ে বাতাস ভারী করে তুলছে। গত বছর জুলাই-এ ছাত্র-জনতার ঐক্য গড়ে উঠেছিল হাসিনা-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সেই ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে। যদিও হাসিনা-আওয়ামী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজে তাদের বড় ধরনের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তথাপি এটা বাস্তবতা যে, তারা এখন আর ক্ষমতায় নেই। প্রকাশ্যে কাজও করতে পারছে না। এ অবস্থায় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মসৃণ ঐক্যের কোনো ভিত্তি আছে কি? হাসিনা-ফ্যাসিবাদীদেরকে বিদায় করার ইস্যু বাদে আর কি কোনো কর্মসূচি বা ঐক্য ঐ আন্দোলনে ছিল? ছিল না, যতই বর্তমানের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন পক্ষ বিবিধ ব্যাখ্যা দিক না কেন। এখন তারা দাবি করছে, ফ্যাসিবাদ বিতাড়ন করে সংস্কার চালানোর ম্যান্ডেট তাদের জনগণ দিয়েছে। কী সংস্কার? পিআর, দ্বিকক্ষ, নারী আসন সংখ্যা ইত্যাদি ধরনের পদ্ধতিগত বিষয়। এমনকি সংবিধান বাতিলের কথাও বলছে সরকারি পার্টি নাপা। কিন্তু তাদের নতুন সংবিধানটির শ্রেণি-চরিত্র কী হবে? তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা কী? সেটা তারাও জানেন না। চুঁইয়ে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে তারা ’৪৭ সালের সাথে ’৭১-কে দাঁড় করিয়ে তার উপর ’২৪-কে আনতে চায়। কতটা বেকুফ আর গণ-বিরোধী হলে এমনটা করা যায়! অন্যদিকে বিএনপি ’৭১-কে রাখতে চায় তাদের মতো করে– যা ভিন্নরূপে আওয়ামী ’৭১-চেতনাই বটে। আর জামাত রাজাকার রাজনীতিকেই চালাচ্ছে। ঐক্যটা কোথায়? এখন একটি ঐকমত্য কমিশন বৈঠকের পর বৈঠক করে নিজেদের স্বাস্থ্য দুর্বল করে ফেলেছে। এখন জুলাই ঘোষণা নামের একটি মোয়া ধরিয়ে দেবার গলদঘর্ম চেষ্টা চালাচ্ছে। সব বুর্জোয়া দলগুলো তো বটেই, এমনকি ভুয়া বামপন্থি ছোট দলগুলোও এসব আলোচনায় কৃতজ্ঞ চিত্তে অংশ নিচ্ছে। সবগুলো ব্যাঙকে এক পাল্লায় তোলার অসাধ্য কর্তব্যে বড় বড় পন্ডিত বুদ্ধিজীবীগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কিছু গৌণ পদ্ধতিগত বিষয়ে একমত হয়েছে। বলছে এসব সংস্কার করলে নাকি আর ফ্যাসিবাদ দেশে আসবে না। কে বলেছে আসবে না? দেশের যে মৌলিক ব্যবস্থা– নয়া উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক, যেখানে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের দালাল বড় ধনী শ্রেণিটি রাষ্ট্রক্ষমতা চালায়– সেটাই যে সকল স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয় ও দিতে বাধ্য, এই সত্যটি এরা লুকিয়ে রাখতে চায়। এ ব্যবস্থাধীনে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার, গণবিরোধী সন্ত্রাস, অতি-মুনাফা ও শোষণ, নারী নিপীড়ন, জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়ন, অসাম্য-বৈষম্য ....... .... এসবতো অনিবার্য। সংবিধান বদল করে বা স্থগিত করে বা বাতিল করে প্রকাশ্য স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা কঠিন কিছু নয়। মুজিব, এরশাদ, হাসিনা তা প্রমাণ করেছে। যারা ঐকমত্য কমিশনে যাচ্ছে তাদের মাঝে পতিত হাসিনা-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা বাহ্যিক ঐক্য রয়েছে বটে। আর প্রকৃত ঐক্য রয়েছে বিদ্যমান সমাজ-ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে। এছাড়া অসংখ্য প্রশ্নে তাদের ঐক্য নেই। এমনকি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বড় গলা করলেও তারা ভিন্ন গোত্রের ফ্যাসিবাদীদের গলা জড়িয়ে রয়েছে, যাদের মাঝে রয়েছে ’৭১-এর খুনী ফ্যাসিস্ট জামাতসহ ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদীরা। রয়েছে বিরাজনীতিকরণের প্রবক্তা তথাকথিত তৃতীয় শক্তির গোষ্ঠীটি, যারা এখন বিরাজনীতিকরণকে জনপ্রিয় করতে না পেরে একটি কিংস পার্টিকে মদদ দিচ্ছে বিবিধ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে, বিশেষত বুর্জোয়া নির্বাচনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। একাজে তারা জামাত ও ধর্মবাদীদের মতো শক্তিগুলোকেও জুটিয়েছে, যারা প্রকৃতপক্ষে দালাল বুর্জোয়া অর্থেও কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ চায় না। এমনকি আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদেরকেও তারা সমূলে উচ্ছেদ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, যা তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীই এখন বলছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অনেক পার্টিই নির্বাচন দ্রুত চাইছে বোধগম্য কারণেই। মুখে ঐক্যের কথা বললেও এখন তারা তৃতীয় শক্তি ও তাদের মিত্রদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। সেকথা তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলাও শুরু করেছে। কিন্তু নির্বাচন যদি হয়ও, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলে, অথবা জুনে, তাতে এদের যে-ই জিতুক, দেশ ও জনগণের কোন সমস্যাটির সঠিক সমাধান হবে? বিএনপি বলছে তারা বহুপূর্বেই ৩১-দফা দিয়ে সংস্কারের কথা বলেছে, জামাত দাবি করছে এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ, নাপা বলছে তারা দেশ গড়বে, বাংলাদেশ পুনর্গঠন করবে– এসবে শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-আদিবাসী-নারীসহ ব্যাপক জনগণের কোন মূর্ত-নির্দিষ্ট কর্মসূচির কথাটি রয়েছে? শ্রমিকের অধিকার ও ক্ষমতা দূরের কথা, তাদের মজুুরির কী সংস্কার করছে এ কমিশন? বরং দ্রব্যমূল্য বেড়ে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি দিন দিন কমে যাচ্ছে। নারীদের সম্পত্তির অধিকারের একটিমাত্র দাবি নারী কমিশন তোলার সাথে সাথে ধর্মবাদীদের চাপে তাকে মাটির নিচে এরা সবাই মিলে চাপা দিয়েছে। এরা পলিথিন বন্ধ করবে বলে ব্যর্থ ঘোষণা দিয়েছে। ভারতে ইলিশ পাঠাবে না বলে এখন ইলিশের সাথে হাসিনা মার্কা আমও পাঠাচ্ছে। উপরন্তু, নির্বাচন ও সংবিধানের কিছু পদ্ধতিগত সংস্কার নিয়ে তারা গলদঘর্ম হয়ে উঠেছে। নাপা অবশ্য সংবিধানটিই এখন বদলে ফেলতে চায়, যদিও তাদের নেতারা হাসিনার সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েই উপদেষ্টা হয়েছিল। এগুলো কি মূর্খতা, নাকি প্রতারণা? এরা একদিকে বলছে সংবিধান বাতিল করতে হবে, জুলাই সনদ না হলে তারা নির্বাচনই করবেন না, অন্যদিকে চলমান সংবিধানের পদ্ধতিগত প্রশ্নে মতামত দিয়ে তারা এই গড্ডালিকায় ঠিকই সামিল হয়েছেন। কিছু কিছু বিপ্লবী বুলি ঝেড়ে তারা এখনো নিজেদের বড় বিপ্লবী প্রমাণ করতে চান যার দ্বারা তারা সংগ্রামী ছাত্র-তরুণ-জনগণের একাংশকে বিভ্রান্ত করছেন। পিআর ভালো না প্রচলিত প্রথা ভালো, দ্বিকক্ষ না পূর্বের মতো এককক্ষ, নারীরা নির্বাচিত হবেন না মনোনিত হবেন, নির্বাচন এখনি না পরে, আগে স্থানীয় নির্বাচন না জাতীয় নির্বাচন– এসব পদ্ধতিগত সমস্যা তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যখন একটি প্রকৃত বিপ্লব ঘটবে। চলমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে এসব বিষয়কে সামনে আনার উদ্দেশ্য একটাই– নির্বাচনে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থটা হাসিল করার চেষ্টা। এসব কোন্দলের সাথে জনগণের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক নেই। আসল বিষয়টা হলো– এই ব্যবস্থাধীনে দেশের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির মধ্যে ঐক্য নেই। তাদের মধ্যে রয়েছে তীব্র কামড়াকামড়ি– ক্ষমতার বড় ভাগটা দখল করার জন্য। অন্যদিকে আবার আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভয়ও রয়েছে। গোপালগঞ্জের ঘটনায় অনেকেরই টনক নড়েছে। আবার একটা অংশ যে তৃতীয় শক্তির অসাংবিধানিক ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত সেটাও গোপন থাকছে না। বিএনপিসহ বড় এক অংশ দ্রুত নির্বাচন চায়, কারণ তা না হলে ক্ষমতায় যাবার সুবর্ণ সুযোগটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অন্যদিকে কোনো অজানা আতঙ্কে ইউনূস একবার পদত্যাগ করতে চান, আরেকবার লন্ডনে গিয়ে আপসরফার বৈঠক করেন। এদিকে আবার লন্ডন-বৈঠকে ইউনূসের হালকা মোচড়ে ক্ষেপে গিয়ে নাপা ও জামাত ইউনূস সরকারের সমালোচনা করে, ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। কিন্তু ক্ষমতার মধু খাওয়া ছাড়তে চায় না। দেখা যাচ্ছে প্রায় বিষয়েই বিভেদ। কিন্তু তাদের ব্যবস্থাটিকে চালিয়ে নেবার জন্য একটা ঐক্য তাদের প্রয়োজনও বটে। সে কারণেই ঐক্য নিয়ে এত চেঁচামেচি এবং বিবিধ দরাদরি। বাহ্যত ঐক্যের যে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে তা কতটা বুর্জোয়া অর্থেও গণতন্ত্রের জন্য বা একটি নির্বাচনের জন্য, আর কতটা তাকে আটকে দেয়ার জন্য– সেটা আগামীতে আরো পরিষ্কার হবে। তবে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেয়া, বা বানচাল করার ষড়যন্ত্রের কথা অনেকেই বলছেন। ষড়যন্ত্র শুধু আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলেও বর্তমানে নির্বাচন ও সংস্কারের ফেরিওয়ালাদের মধ্য থেকেও যে সেগুলো চলছে সেটা অনেকের কথাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রমিক, কৃষকসহ ব্যাপক নিপীড়িত জনগণকে শাসকশ্রেণির মধ্যকার এসব বিতর্ক-বিভেদ, ঐক্য, নির্বাচন, ষড়যন্ত্র, আন্দোলন– ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এদের সবার বিপরীতে জনগণের নিজস্ব কর্মসূচিকে সামনে আনতে হবে। সেটা এক দফা– বিপ্লব। প্রকৃত বিপ্লব। বিএনপি-মার্কা, জামাত-মার্কা, নাপা-মার্কা, ইউনূস-মার্কা, ফরহাদ মাজহার-মার্কা তথাকথিত বিপ্লব নয়, যারা কিনা বিপ্লবের সম্ভাবনার প্রথম দিনটিতেই, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে পদদলিত করেছে। যে বিপ্লব জনগণের মূল শত্রু বড় ধনী শাসকশ্রেণির এই সমগ্র দঙ্গলটিকে উচ্ছেদ করবে এবং প্রকৃতই শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে কাজ করবে। সে লক্ষ্যে সচেতন হয়ে নিরলস কাজ করে যেতে হবে বিপ্লবী ছাত্র-তরুণদেরকে, শ্রমিক-কৃষককে এবং বিপ্লবী সংগঠনগুলোকে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
ঐক্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচন– শাসকশ্রেণি গলদঘর্ম
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিন যতই পার হচ্ছে, ততই শাসকশ্রেণির বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দল, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বেড়ে চলেছে। আর তাকে জনগণের কাছে গোপন করার জন্য তারা ঐক্যের গলাবাজী দিয়ে বাতাস ভারী করে তুলছে। গত বছর জুলাই-এ ছাত্র-জনতার ঐক্য গড়ে উঠেছিল হাসিনা-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সেই ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে। যদিও হাসিনা-আওয়ামী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজে তাদের বড় ধরনের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তথাপি এটা বাস্তবতা যে, তারা এখন আর ক্ষমতায় নেই। প্রকাশ্যে কাজও করতে পারছে না। এ অবস্থায় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মসৃণ ঐক্যের কোনো ভিত্তি আছে কি? হাসিনা-ফ্যাসিবাদীদেরকে বিদায় করার ইস্যু বাদে আর কি কোনো কর্মসূচি বা ঐক্য ঐ আন্দোলনে ছিল? ছিল না, যতই বর্তমানের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন পক্ষ বিবিধ ব্যাখ্যা দিক না কেন। এখন তারা দাবি করছে, ফ্যাসিবাদ বিতাড়ন করে সংস্কার চালানোর ম্যান্ডেট তাদের জনগণ দিয়েছে। কী সংস্কার? পিআর, দ্বিকক্ষ, নারী আসন সংখ্যা ইত্যাদি ধরনের পদ্ধতিগত বিষয়। এমনকি সংবিধান বাতিলের কথাও বলছে সরকারি পার্টি নাপা। কিন্তু তাদের নতুন সংবিধানটির শ্রেণি-চরিত্র কী হবে? তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা কী? সেটা তারাও জানেন না। চুঁইয়ে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে তারা ’৪৭ সালের সাথে ’৭১-কে দাঁড় করিয়ে তার উপর ’২৪-কে আনতে চায়। কতটা বেকুফ আর গণ-বিরোধী হলে এমনটা করা যায়! অন্যদিকে বিএনপি ’৭১-কে রাখতে চায় তাদের মতো করে– যা ভিন্নরূপে আওয়ামী ’৭১-চেতনাই বটে। আর জামাত রাজাকার রাজনীতিকেই চালাচ্ছে। ঐক্যটা কোথায়? এখন একটি ঐকমত্য কমিশন বৈঠকের পর বৈঠক করে নিজেদের স্বাস্থ্য দুর্বল করে ফেলেছে। এখন জুলাই ঘোষণা নামের একটি মোয়া ধরিয়ে দেবার গলদঘর্ম চেষ্টা চালাচ্ছে। সব বুর্জোয়া দলগুলো তো বটেই, এমনকি ভুয়া বামপন্থি ছোট দলগুলোও এসব আলোচনায় কৃতজ্ঞ চিত্তে অংশ নিচ্ছে। সবগুলো ব্যাঙকে এক পাল্লায় তোলার অসাধ্য কর্তব্যে বড় বড় পন্ডিত বুদ্ধিজীবীগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কিছু গৌণ পদ্ধতিগত বিষয়ে একমত হয়েছে। বলছে এসব সংস্কার করলে নাকি আর ফ্যাসিবাদ দেশে আসবে না। কে বলেছে আসবে না? দেশের যে মৌলিক ব্যবস্থা– নয়া উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক, যেখানে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের দালাল বড় ধনী শ্রেণিটি রাষ্ট্রক্ষমতা চালায়– সেটাই যে সকল স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন ও ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয় ও দিতে বাধ্য, এই সত্যটি এরা লুকিয়ে রাখতে চায়। এ ব্যবস্থাধীনে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার, গণবিরোধী সন্ত্রাস, অতি-মুনাফা ও শোষণ, নারী নিপীড়ন, জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়ন, অসাম্য-বৈষম্য ....... .... এসবতো অনিবার্য। সংবিধান বদল করে বা স্থগিত করে বা বাতিল করে প্রকাশ্য স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা কঠিন কিছু নয়। মুজিব, এরশাদ, হাসিনা তা প্রমাণ করেছে। যারা ঐকমত্য কমিশনে যাচ্ছে তাদের মাঝে পতিত হাসিনা-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা বাহ্যিক ঐক্য রয়েছে বটে। আর প্রকৃত ঐক্য রয়েছে বিদ্যমান সমাজ-ব্যবস্থাটিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে। এছাড়া অসংখ্য প্রশ্নে তাদের ঐক্য নেই। এমনকি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বড় গলা করলেও তারা ভিন্ন গোত্রের ফ্যাসিবাদীদের গলা জড়িয়ে রয়েছে, যাদের মাঝে রয়েছে ’৭১-এর খুনী ফ্যাসিস্ট জামাতসহ ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদীরা। রয়েছে বিরাজনীতিকরণের প্রবক্তা তথাকথিত তৃতীয় শক্তির গোষ্ঠীটি, যারা এখন বিরাজনীতিকরণকে জনপ্রিয় করতে না পেরে একটি কিংস পার্টিকে মদদ দিচ্ছে বিবিধ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে, বিশেষত বুর্জোয়া নির্বাচনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। একাজে তারা জামাত ও ধর্মবাদীদের মতো শক্তিগুলোকেও জুটিয়েছে, যারা প্রকৃতপক্ষে দালাল বুর্জোয়া অর্থেও কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ চায় না। এমনকি আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদেরকেও তারা সমূলে উচ্ছেদ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, যা তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীই এখন বলছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অনেক পার্টিই নির্বাচন দ্রুত চাইছে বোধগম্য কারণেই। মুখে ঐক্যের কথা বললেও এখন তারা তৃতীয় শক্তি ও তাদের মিত্রদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। সেকথা তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলাও শুরু করেছে। কিন্তু নির্বাচন যদি হয়ও, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলে, অথবা জুনে, তাতে এদের যে-ই জিতুক, দেশ ও জনগণের কোন সমস্যাটির সঠিক সমাধান হবে? বিএনপি বলছে তারা বহুপূর্বেই ৩১-দফা দিয়ে সংস্কারের কথা বলেছে, জামাত দাবি করছে এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ, নাপা বলছে তারা দেশ গড়বে, বাংলাদেশ পুনর্গঠন করবে– এসবে শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-আদিবাসী-নারীসহ ব্যাপক জনগণের কোন মূর্ত-নির্দিষ্ট কর্মসূচির কথাটি রয়েছে? শ্রমিকের অধিকার ও ক্ষমতা দূরের কথা, তাদের মজুুরির কী সংস্কার করছে এ কমিশন? বরং দ্রব্যমূল্য বেড়ে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি দিন দিন কমে যাচ্ছে। নারীদের সম্পত্তির অধিকারের একটিমাত্র দাবি নারী কমিশন তোলার সাথে সাথে ধর্মবাদীদের চাপে তাকে মাটির নিচে এরা সবাই মিলে চাপা দিয়েছে। এরা পলিথিন বন্ধ করবে বলে ব্যর্থ ঘোষণা দিয়েছে। ভারতে ইলিশ পাঠাবে না বলে এখন ইলিশের সাথে হাসিনা মার্কা আমও পাঠাচ্ছে। উপরন্তু, নির্বাচন ও সংবিধানের কিছু পদ্ধতিগত সংস্কার নিয়ে তারা গলদঘর্ম হয়ে উঠেছে। নাপা অবশ্য সংবিধানটিই এখন বদলে ফেলতে চায়, যদিও তাদের নেতারা হাসিনার সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েই উপদেষ্টা হয়েছিল। এগুলো কি মূর্খতা, নাকি প্রতারণা? এরা একদিকে বলছে সংবিধান বাতিল করতে হবে, জুলাই সনদ না হলে তারা নির্বাচনই করবেন না, অন্যদিকে চলমান সংবিধানের পদ্ধতিগত প্রশ্নে মতামত দিয়ে তারা এই গড্ডালিকায় ঠিকই সামিল হয়েছেন। কিছু কিছু বিপ্লবী বুলি ঝেড়ে তারা এখনো নিজেদের বড় বিপ্লবী প্রমাণ করতে চান যার দ্বারা তারা সংগ্রামী ছাত্র-তরুণ-জনগণের একাংশকে বিভ্রান্ত করছেন। পিআর ভালো না প্রচলিত প্রথা ভালো, দ্বিকক্ষ না পূর্বের মতো এককক্ষ, নারীরা নির্বাচিত হবেন না মনোনিত হবেন, নির্বাচন এখনি না পরে, আগে স্থানীয় নির্বাচন না জাতীয় নির্বাচন– এসব পদ্ধতিগত সমস্যা তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যখন একটি প্রকৃত বিপ্লব ঘটবে। চলমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে এসব বিষয়কে সামনে আনার উদ্দেশ্য একটাই– নির্বাচনে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থটা হাসিল করার চেষ্টা। এসব কোন্দলের সাথে জনগণের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক নেই। আসল বিষয়টা হলো– এই ব্যবস্থাধীনে দেশের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির মধ্যে ঐক্য নেই। তাদের মধ্যে রয়েছে তীব্র কামড়াকামড়ি– ক্ষমতার বড় ভাগটা দখল করার জন্য। অন্যদিকে আবার আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভয়ও রয়েছে। গোপালগঞ্জের ঘটনায় অনেকেরই টনক নড়েছে। আবার একটা অংশ যে তৃতীয় শক্তির অসাংবিধানিক ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত সেটাও গোপন থাকছে না। বিএনপিসহ বড় এক অংশ দ্রুত নির্বাচন চায়, কারণ তা না হলে ক্ষমতায় যাবার সুবর্ণ সুযোগটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অন্যদিকে কোনো অজানা আতঙ্কে ইউনূস একবার পদত্যাগ করতে চান, আরেকবার লন্ডনে গিয়ে আপসরফার বৈঠক করেন। এদিকে আবার লন্ডন-বৈঠকে ইউনূসের হালকা মোচড়ে ক্ষেপে গিয়ে নাপা ও জামাত ইউনূস সরকারের সমালোচনা করে, ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। কিন্তু ক্ষমতার মধু খাওয়া ছাড়তে চায় না। দেখা যাচ্ছে প্রায় বিষয়েই বিভেদ। কিন্তু তাদের ব্যবস্থাটিকে চালিয়ে নেবার জন্য একটা ঐক্য তাদের প্রয়োজনও বটে। সে কারণেই ঐক্য নিয়ে এত চেঁচামেচি এবং বিবিধ দরাদরি। বাহ্যত ঐক্যের যে চেষ্টা দেখা যাচ্ছে তা কতটা বুর্জোয়া অর্থেও গণতন্ত্রের জন্য বা একটি নির্বাচনের জন্য, আর কতটা তাকে আটকে দেয়ার জন্য– সেটা আগামীতে আরো পরিষ্কার হবে। তবে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেয়া, বা বানচাল করার ষড়যন্ত্রের কথা অনেকেই বলছেন। ষড়যন্ত্র শুধু আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলেও বর্তমানে নির্বাচন ও সংস্কারের ফেরিওয়ালাদের মধ্য থেকেও যে সেগুলো চলছে সেটা অনেকের কথাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রমিক, কৃষকসহ ব্যাপক নিপীড়িত জনগণকে শাসকশ্রেণির মধ্যকার এসব বিতর্ক-বিভেদ, ঐক্য, নির্বাচন, ষড়যন্ত্র, আন্দোলন– ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এদের সবার বিপরীতে জনগণের নিজস্ব কর্মসূচিকে সামনে আনতে হবে। সেটা এক দফা– বিপ্লব। প্রকৃত বিপ্লব। বিএনপি-মার্কা, জামাত-মার্কা, নাপা-মার্কা, ইউনূস-মার্কা, ফরহাদ মাজহার-মার্কা তথাকথিত বিপ্লব নয়, যারা কিনা বিপ্লবের সম্ভাবনার প্রথম দিনটিতেই, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে পদদলিত করেছে। যে বিপ্লব জনগণের মূল শত্রু বড় ধনী শাসকশ্রেণির এই সমগ্র দঙ্গলটিকে উচ্ছেদ করবে এবং প্রকৃতই শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে কাজ করবে। সে লক্ষ্যে সচেতন হয়ে নিরলস কাজ করে যেতে হবে বিপ্লবী ছাত্র-তরুণদেরকে, শ্রমিক-কৃষককে এবং বিপ্লবী সংগঠনগুলোকে।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র